কানের যত্নে জরুরি সচেতনতা

অনেকে জন্মগতভাবে শ্রবণশক্তির সমস্যায় ভোগে থাকেন, ফলে যোগাযোগটা আর হয়ে ওঠে না। আবার কেউ কানের যত্ন নিয়ে অবহেলা করার কারণেও শ্রবণ সমস্যায় ভুগে থাকেন, যা জীবন চলার পথে বিভিন্ন সমস্যা হিসেবে দেখা দেয়। এজন্য কানের প্রতি আরও যত্নবান হওয়া উচিত।
বিশ্বেজুড়ে আনুমানিক সাড়ে ৪৬ কোটি মানুষ শ্রবণ হ্রাসজনিত সমস্যা নিয়ে বেঁচে আছে। আশঙ্কার বিষয়টি হচ্ছে, সঠিক ও সময়োপযোগী ব্যবস্থা না নিলে ২০৩০ সালের মধ্যে এই সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ৬৩০ মিলিয়ন। বধিরতা ও শ্রবণ সমস্যা একটি সামাজিক ব্যাধি। প্রতি চারজনে একজনই এই সমস্যায় ভুগবে এবং প্রায় ৭০ কোটি মানুষের শ্রবণযন্ত্র লাগবে। বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে শ্রবণ সমস্যায় ভুগছে বলে এক গবেষণায় জানা গেছে। বিশ্ব শ্রবণ দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য বা থিম হচ্ছে ‘শুনতে চাইলে আজীবন, শোনায় চাই সযত্ন’।
শ্রবণত্রুটির কারণ
* জন্মগত ত্রুটির কারণে শ্রবণত্রুটি সমস্যা হতে পারে।
* বংশ ও জিনগত কারণে হতে পারে।
* প্রসবকালীন বিভিন্ন জটিলতার কারণে হতে পারে। যেমন: কম ওজন, প্রিম্যাচিউরিটি, বার্থ এসফ্যাক্সিয়া, নিউনেটাল জন্ডিসেও বধিরতা হতে পারে।
* মায়ের গর্ভকালীন কিছু সংক্রমণ বধিরতার জন্য দায়ী। যেমন: সাইটোমেগালো ভাইরাস, রুবেলা, মাম্পস ইত্যাদি।
* শিশুর মেনিনজাইটিস বা ব্রেনে কনফেশন ও ভাইরাসজনিত রোগ। যেমন: মাম্পস, মিসেলস।
* উচ্চ শব্দের কারণে হতে পারে। হেডফোনের বেশি ভলিউম, উচ্চ শব্দের মিউজিক ও কনসার্ট, আতশবাজির শব্দ, রাস্তার গাড়ির হর্ন, নির্মাণকাজ ও কলকারখানার শব্দ এবং বজ্রপাতের বিকট শব্দ কানের জন্য ক্ষতিকর।
* কানের ভিভিন্ন ক্ষতিকর ওষুধের ব্যবহার করার কারণে হতে পারে।
* কানে আঘাত ও দুর্ঘটনায় শ্রবণত্রুটি হতে পারে।
* ধূমপান, রক্তে চর্বি জমা, পুষ্টিহীনতা ও হঠাৎ খারাপ ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের কারণে শ্রবণত্রুটি হতে পারে।
* অনেক দিনের কানের প্রদাহ বা ইনফেকশন থাকলেও ত্রুটি হতে পারে।
* শিশু ও কিশোরদের অনেক দিনের টনসিলে ইনফেশন ও এডিনয়েডের জন্য মধ্যকর্ণে পানি জমার কারণে শ্রবণত্রুটি হতে পারে।
* অনেক দিন কানে ময়লা জমার কারণে শ্রবণ শ্রবণত্রুটি হতে পারে।
* বয়সজনিত কারণেও শ্রবণশক্তি হ্রাস পেতে পারে।
শ্রবণত্রুটি প্রতিরোধে করণীয়
* বংশ ও জিনগত বধিরতা দূর করতে সচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। জেনেটিক রোগ সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। বিশেষ করে কনসেনগুয়াল ম্যারেজ তথা রক্ত সম্পর্কিত বিবাহ (কাজিন-কাজিন) পরিহার করতে হবে।
* জন্মগত ত্রুটি দূর করতে নিরাপদ গর্ভধারণ ও প্রসব নিশ্চিত করতে হবে।
* জন্ম-পরবর্তী নবজাতকের সঠিক যত্ন ও চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে।
* জন্মের পরপরই কানের শ্রবণশক্তি পরীক্ষা করা এবং সেটি স্বাভাবিক স্ক্রিনিং প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসা। এক্ষেত্রে দ্রুত রোগ নির্ণয় করে সঠিক চিকিৎসা নেওয়া জরুরি।
অনলাইনে মেডিসিন অর্ডার করতে ভিজিট করুন দেশের সর্ব বৃহৎ অনলাইন মেডিসিন মার্কেট---
শ্রবণত্রুটির চিকিৎসা
শোনা ও কথা বলার সঙ্গে একটা সেতুবন্ধন রয়েছে। প্রতিটি মানবশিশু প্রথমে শোনে। পরে সে অনুযায়ী, কথা বলতে চেষ্টা করে অর্থাৎ জন্মবধিরতা বাকশক্তি বিকাশের অন্তরায়। শিশু যদি আশপাশের বড় আওয়াজ বা শব্দে চমকে ওঠে, যদি ছয় মাস বয়সে শব্দের উৎসর দিকে মাথা ঘুরিয়ে দেখতে চেষ্টা না করে, এমনকি এক বছর বয়স হওয়ার পরেও কোনো অর্থপূর্ণ শব্দ না বলে, যদি দুই বছর বয়সের মধ্যে দুটি শব্দের বাক্য না বলে তাহলে দেরি না করে নাক-কান-গলা রোগ বিশেষজ্ঞ ও হেড-নেক সার্জনের কাছে যেতে হবে।
এক্ষেত্রে ক্লিনিক্যাল অ্যাসেসমেন্ট ও অডিওলজিক্যাল পরীক্ষার মাধ্যমে রোগ নির্ণয় করে ককলিয়ার ইমপ্লান্ট (অন্তঃকর্ণ প্রতিস্থাপন) নামক একটি অপারেশনের মাধ্যমে শিশুর শোনা ও কথা বলার ক্ষমতা ফিরিয়ে আনা সম্ভব। তবে এটি খুবই ব্যয়বহুল অপারেশন। তবে বাংলাদেশ সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে ফ্রি ইমপ্লান্ট বরাদ্দ দেওয়ার মাধ্যমে এটি সহজলভ্য হয়েছে। বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (পিজি হাসপাতাল), সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ), মহাখালী জাতীয় নাক কান-গলা ইনস্টিটিউট, ঢাকা মেডিকেল কলেজে অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে এ অপারেশন করা হয়।
* একজন সুস্থ স্বাভাবিক শ্রবণত্রুটি মুক্ত শিশু পেতে মা ও শিশুর টিকা নিশ্চিত করতে হবে।
* শিশু বয়সে কোনো ভাইরাসজনিত রোগ বিশেষ করে জ্বর হলে দ্রুত সঠিক চিকিৎসা নেওয়া এবং কানে শোনার সমস্যা আছে কি না খেয়াল রাখা।
* বাচ্চাদের টনসিলে ইনফেশন ও এডিনয়েডের (নাকের পেছনের টনসিল) সঠিক চিকিৎসা নেওয়া এবং প্রয়োজনে সার্জারি করানো উচিত।
* কান থেকে পানি, পুঁজ, রক্ত ঝড়লে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যাওয়া এবং সঠিক চিকিৎসা নেওয়া উচিত।
* দীর্ঘদিন ধরে কানের প্রদাহ বা পর্দায় ছিদ্র থাকলে সঠিক চিকিৎসা নেওয়া, প্রয়োজনে অপারেশনের মাধ্যমে জোড়া লাগানো উচিত।
* বয়স্কজনিত কারণে বা অন্য যেকোনো কারণে শোনার সমস্যা হলে কানের শ্রবণ পরীক্ষা-পরবর্তী রোগ নির্ণয় করে অনেক ক্ষেত্রে শ্রবণযন্ত্রের সাহায্যে কানে শোনার ক্ষমতা ফিরিয়ে আনা যায়।
* শব্দদূষণ পরিহার করতে হবে। কারণ দেশে শব্দদূষণ ভয়াভহ রূপ ধারণ করেছে। বাংলাদেশে শব্দদূষণ প্রতিরোধ আইন অনুযায়ী, আবাসিক এলাকায় রাত ৯টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত শব্দের মাত্রা ৪৫ ডেসিবেল এবং দিনের অন্য সময়ে ৫৫ ডেসিবেল অতিক্রম করতে পারবে না। অথচ পরিবেশ অধিদপ্তরের এক জরিপ অনুযায়ী, দেশের বিভাগীয় শহরগুলোয় শব্দের মাত্রা ১৩০ ডেসিবেল ছাড়িয়ে গেছে, যা স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে আড়াই থেকে তিন গুণ বেশি এবং কানের স্থায়ী বধিরতার জন্য যথেষ্ট। সুতরাং শব্দদূষণ প্রতিরোধ আইনের যথেষ্ট প্রয়োগ ও সচেতনতা জরুরি। যত্রতত্র অপ্রয়োজনীয় হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার না করা, নির্মাণকাজে শব্দদূষণের হার নিয়ন্ত্রণ, কলকারখানা ও জেনারেটরের শব্দ নিয়ন্ত্রণ, পরিকল্পিত নগরায়ণ, উচ্চ শব্দের কনসার্ট ও মাইকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে কর্তৃপক্ষের কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
* বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কানে কোনো ওষুধ, তেল অথবা ড্রপ ব্যবহার করা যাবে না। কানে ময়লা বা খৈল জমে কান বন্ধ হলে বা কানের মধ্যে বাইরের কোনো বস্তু প্রবেশ করলে অপসারণ